আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকরা যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে একদিকে যেমন বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করা দরকার, তেমনি সাংবাদিকতায় পেশাদার চর্চাও বাড়াতে হবে। সাংবাদিকদের সরকারের কাছে নয়, জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হবে।অন্যদিকে মব বা বিশৃঙ্খলা তৈরি করে কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের অফিসে হামলা করে রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব নয়।
বরং ক্ষমতার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে সংস্কার ও নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।গতকাল শুক্রবার রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কমপ্লেক্সের (কেআইবি) থ্রিডি সেমিনার হলে আয়োজিত এক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। দ্য বাংলাদেশ ডায়লগ আয়োজিত ‘মিডিয়া স্বাধীনতা: একটি কার্যকরী গণতন্ত্রের ভিত্তি’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে ছিলেন নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল, নির্মাতা আশফাক নিপুন ও এবং কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ।নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র, গণমাধ্যম ও সাধারণ জনগণের ওপর বড় পর্যায়ে হামলার সূত্রপাত শুরম্ন হয় ওয়ান ইলেভেন থেকে।
এরপর প্রতি বছরই এটা ক্রমে অবনতির দিকে গেছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করতে হবে এবং প্রতিটি মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। নির্যাতিতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের ব্যর্থতা তুলে ধরে তাসনিম খলিল বলেন, ২০০৮ সঙ্গে তুলনামূলক ভালো একটি নির্বাচন হলো।আওয়ামী লীগের খুব প্রগতিশীল ও উদার একটি নির্বাচনী ইশতেহার ছিল। এরপর ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ, ২০১১ সালে পুরোপুরি পুরোপুরি একটি ভুয়া ঘটনা সাজানো হলো যে সেনাবাহিনীতে একটা অভ্যুত্থান হয়েছে, ২০১৩ সালে শাহবাগ ও শাপলা চত্বরের ঘটনা, ২০১৮ সালের ঘটনা (জাতীয় সংসদ নির্বাচন) প্রতিটি ঘটনায় আমরা বাংলাদেশি সাংবাদিক ও সম্পাদকরা গুরুতরভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
তাসনিম খলিল বলেন, আমার কাছে যদি প্রেস ফ্রিডম (সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা) থাকে এবং এটাকে যদি আমি ব্যবহার না করি তাহলে তো এটা একদিন না একদিন ভোঁতা হয়ে যাবেই। পৃথিবীর কোথাও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শাসক বা সরকার দেয় না। এটা সব সময় শিল্পী, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকরা আদায় করে নিয়েছেন।
আমি মনে করি এক্ষেত্রে বড় পরিসরে আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ ব্যর্থ হয়েছে।’সাংবাদিকতায় পেশাদার চর্চার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাসনিম খলিল বলেন, ২০১৮ সালের আগে তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ছিল না। তাহলে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যথাযথ ভূমিকা পালন করা গেল না কেন? আমরা সাংবাদিকরা সরকারের কাছে নয়, পাঠক-শ্রোতা-দর্শক বা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চাই।নির্মাতা আশফাক নিপুণ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে আলোচিত ‘মহানগর’ ওয়েব সিরিজ বানানোর পর হয়রানি ও তিক্ত অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘এটা নিয়ে এখন আমি খোলাখুলি বলব না। কারণ যা হয়েছে সেটা নিয়েই আমি একটা কন্টেন্ট তৈরি করব। তবে মহানগর বানানোর এক মাস পর আমার কাছে ফোন আসে। আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। গ্রামের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল। মহানগরে অভিনয় করা প্রায় প্রত্যেক শিল্পীর বাসায় পুলিশ গিয়েছিল আমার সম্পর্কে জানার জন্য।’
সেন্সর বোর্ডে নাম প্রসত্মাব ও পরে বোর্ডে থাকতে তাঁর অপারগতা জানানো প্রসঙ্গে নিপুন বলেন, ‘প্রথমত আমার কনসেন্ট (সম্মতি) নেওয়া হয়নি। আমি আর্ট ফর্মে যেকোনো সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে। এমনকি কেউ যদি সরকারি প্রোপাগান্ডা কিছু বানাতে চায় সেটারও পক্ষে। সার্টিফিকেশন বোর্ড হলে আমি তাহলে হয়তো বিবেচনা করতাম। আমাদের সেল্ফ সেন্সরশিপ থেকেও বের হয়ে আসতে হবে।’হয়রানির নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক এহসান মাহমুদ বলেন, ‘আমার সাংবাদিকতার বয়স ৯ বছর। সাংবাদিকতার শুরুই গত শাসনের মধ্য দিয়েই। আমি তখন একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগে সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করতাম। একদিন একইদিনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ ছিল। আমি সরেজমিনে ঘুরে এসে লিখলাম। লেখায় সমাবেশে দেওয়া তারেক রহমানের ধারণকৃত বক্তব্যের কিছু অংশ উদ্ধৃত করেছিলাম। এটাই ছিল আমার অপরাধ। এর কিছুদিন পর থেকেই অফিসে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সবসময় আমাকে অনুসরণ করা হতো। গ্রামের বাড়িতে পুলিশ গিয়েছিল। আমি চাই কেবল লেখালেখির জন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে এরকম না ঘটে পরিবর্তিত বাংলাদেশে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার চরিত্র বিশেস্নষণ করে এহসান মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন যারাই থাকে, সেটা রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক সরকার হোক, যখন তাদের কাছে সব ক্ষমতা চলে আসে তারা স্বাভাবিক থাকে না। যেমন ৫ আগস্ট পরবর্তী সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তার আইনের ক্ষেত্রে প্রথমে বলল যে এটা শুধু সংস্কার করা হবে। অথচ এর আগে দীর্ঘ সময় আমরা বর্তমান সরকারের আইন উপদেষ্টা কিংবা আরো কোনো কোনো উপদেষ্টার সঙ্গে একসঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে আইনটি বাতিলের দাবিতে। তারা নিজেরাই আইনটিকে কালো আইন, নিপীড়নমূলক আইন, নিবর্তনমূলক আইন ইত্যাদি বলে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু এখন তারা যখন সরকারে গেলেন তখন বলছেন আইনটিকে সংস্কার করা হবে, বাতিল করা হবে না। অর্থাৎ যারাই ক্ষমতায় যায় তারা এরকম করতে চায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই আইনটি অবশ্যই বাতিল করা উচিত।
নিবর্তনমূলক আইন বাতিলের মত দেন নির্মাতা আশফাক নিপুনও। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ যেসব নিবর্তনমূলক আইন তৈরি করা হয়েছে সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল এক রকম। এর ব্যবহার হয়ে যায় আরেক রকম। যেমন শুরুতে বলা হয়েছিল এখানে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হবে না, লেখালেখির ওপর চাপ দেওয়া হবে না। আবার নারীদের সুরক্ষার জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দরকার। কারণ আমরা জানি ডিজিটাল স্পেসে আসলে নারীদের সুরক্ষার জন্য কোনো আইন ছিল না। আমার মনে হয় যেহেতু এটার প্রয়োগ খুবই ন্যক্কারজনকভাবে সাধারণ মানুষের ওপর ঘটে গেছে এ আইন আসলে আর রাখার দরকার নেই। ওই ধরনের সব আইন বাতিল করা উচিত।
জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা উদ্বেগজনক বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় পার্টির অফিসে হামলা প্রসঙ্গে এহসান মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের সামগ্রিক গণতন্ত্রের জন্য এটি খুবই উদ্বেগজনক। এটি যে নামে বা যারাই করুক না কেন এটি কেন হতে দেওয়া হলো?
এহসান মাহমুদ বলেন, বিগত দেড় দশকের প্রধান সমস্যা ছিল ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের এখন উচিত নির্বাচনের দিকে যাওয়া।তাসনিম খলিল বলেন, ‘আমি কিছুদিন আগে ফেসবুকে লিখেছিলাম যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়ক লীগ হয়ে যেতে পারে।... এখানে কিছু লোক আছে এরা আগে ছাত্রলীগ ছিল, গুন্ডাতান্ত্রিক সংগঠনের সদস্য ছিল। এরা এখন বাংলাদেশে আর একবার নতুন গুন্ডাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এই বাংলাদেশে আমরা আরেকবার নতুন গুন্ডাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেব না।